টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর থানাধীন ঘাটান্দী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা ছিলেন কৃষক। শৈশবে যে ছেলেটি বাবাকে সাহায্য করতে ধান কেটেছেন ক্ষেতে, মাঠে- নিজের মেধা, যোগ্যতা আর অধ্যাবসায়ের ওপর ভর করে সেই ছেলেটি পেশাগত জীবনের শেষভাগে এসে বিদায় নিচ্ছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে। সাফল্যের সাথে দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর অবসরে যাচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের চৌকস এই কর্মকর্তা। এ যেন গ্রাম থেকে ওঠে আসা এক মেঠো বালকের নগর জয়ের গল্প।
বলছিলাম অজপাড়া গাঁ থেকে ওঠে আসা ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক’র কথা। ১২তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয়ে খন্দকার গোলাম ফারুক পুলিশ বিভাগে যোগ দেন ২০ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে। এর পরের গল্পটা ঈর্ষণীয় সফলতার।
শৈশব সম্পর্কে বলতে গিয়ে খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, শৈশবকাল গ্রামের আনন্দময় পরিবেশে কেটেছে। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবার বড়। বর্ষায় নতুন পানিতে দৌঁড়ঝাপ, কলা গাছের ভেলায় স্কুলে যাওয়া, গরু চড়ানো, ধান কাটা, বাজারে পাট বিক্রি করা- এমন শত অভিজ্ঞতায় শৈশবকাল কেটেছে গ্রামে। সেই মধুময় শৈশব এখনকার আমাদের বাচ্চারা চিন্তাও করতে পারবে না।
ভুঞাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বারই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন গোলাম ফারুক। এরপর ভুঞাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে এস.এস.সি, ভুঞাপুর ইব্রাহিম খাঁ সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে এইচ.এস.সি সম্পন্ন করেন। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি সম্পন্ন করেন ১৯৮৮ সালে । পরে ২০০৭ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা থেকে সম্পন্ন করেন এম.এ।
গোলাম ফারুক বলেন, আব্বার চাচা (আমার দাদা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. কে টি হোসাইন। আব্বার ইচ্ছা ছিলো আমিও দাদার মতো পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি। আমি সেই মোতাবেক নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকি। এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হই। ভাল তিনটি বিষয়ে চান্স পাই। কিন্তু ততদিনে সংসারের বাস্তবতা অনেকটা বুঝতে শিখেছি। তখন কৃষিতে পাশ করলেই চাকরি, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কৃষিতে পড়ার সময়ও প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পিএইচডি করবো, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হবো। এ সময় পড়াশুনার খরচ চালাতে টিউশন করতাম।
বাবা আমাকে প্রায়শই বলতেন, বড় হয়ে হতদরিদ্র এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। বিপদে সাহায্য করতে হবে। বাবার সে আদেশ পালন করতে মানুষের সেবা করার জন্য আমি পুলিশ হয়েছিলাম বলেন, গোলাম ফারুক।
গোলাম ফারুক বলেন, সেদিন থেকে দীর্ঘ এই চাকরিজীবনে কাজ করেছি অসহায়, দরিদ্র মানুষের জন্য। যতদিন চাকরি করেছি মানুষের জন্য আমরা দরজা সবসময় খোলা ছিলো।
১২ তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ বিভাগে যোগ দেন ২০ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এপিবিএন, বগুড়া তে। পরবর্তীতে সহকারী কমিশনার, সিএমপি, সহকারী পুলিশ সুপার, খাগড়াছড়ি (সার্কেল), সহকারী কমিশনার, ডিএমপিতে কর্মরত ছিলেন।
এরপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলাতে। পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ঠাকুরগাঁও, কিশোরগঞ্জ, ঝালকাঠি, জামালপুর, ময়মনসিংহ জেলায়।
এছাড়া সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এপিবিএন, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ-এ। দায়িত্ব পালন করেছেন এআইজি, পুলিশ সদর দপ্তর, এসএস, সিটিএসবি তে। অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন ডিএমপি’র জয়েন্ট কমিশনার। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে।
ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডিএমপি ও ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রংপুর ও চট্টগ্রাম রেঞ্জ-এ। পরবর্তীতে অতিরিক্ত আইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সারদা পুলিশ একাডেমি‘র প্রিন্সিপাল হিসেবে। দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ স্টাফ কলেজ বাংলাদেশ‘র রেক্টর হিসেবেও।
খন্দকার গোলাম ফারুক ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) পুলিশের ৩৫তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন অতিরিক্তি আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক। গত বছর (২০২২) সালের ২৯ অক্টোবর, শনিবার বিকালে ডিএমপি ৩৫ তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন অতিরিক্তি আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক। এর আগে ২৩ অক্টোবর রোববার রাষ্ট্রপতির অনুমতিক্রমে ডিএমপির কমিশনার হিসেবে পদায়ন হয়েছিলো তাঁর।
খন্দকার গোলাম ফারুক মানুষের পাশে থেকে বিপদে সাহায্য করবেন বলে পুলিশ ক্যাডারে যোগদানের লক্ষ্য নিয়েই নবম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মেধা তালিকায় ছিলেন একেবারে প্রথম দিকে। নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডারে। ক্যাডার পছন্দ না হওয়ায় দশম বিসিএস-এ আবারও অংশগ্রহণ করেন তিনি। এবার মেধা তালিকায় হলেন প্রথম।
এবারও নির্বাচিত হলেন প্রশাসন ক্যাডারে-কিন্তু মানুষকে পাশে থেকে সরাসরি মানুষের সেবা করার সুযোগটা পুলিশ ক্যাডারেও বেশি বলেই তাঁর ও তাঁর বাবা মায়ের আগ্রহ বেশি ছিলো পুলিশ ক্যাডারেই। শেষ চেষ্টা তৃতীয়বারের মতো আবারও দিলেন বিসিএস পরীক্ষা। ১২তম বিসিএস-এ নির্বাচিত হলেন সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে। দুই-দুইটি বছর পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করলেন পেশাগত যুদ্ধ।
বাংলাদেশ পুলিশের সুদীর্ঘ পথচলায় বর্তমানে পুলিশ অনেক বেশি জনবান্ধব বলে মনে করেন খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, বৃটিশ ঔপনিবেশিক ধারণা হতে বাংলাদেশ পুলিশ এখন অনেকটাই মুক্ত, ব্লু এবং হোয়াইট কালার উভয় প্রকার অপরাধীই এখন পুলিশকে ভয় পায়। বর্তমান বাংলাদেশ পুলিশ সাধারণ মানুষের আস্থায় পরিণত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অফিসারের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশের কর্মপরিধি নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলার সাথে তাল মিলিয়ে বিস্তৃত হচ্ছে। যে ডিএমপি মাত্র ৬ হাজার জনবল ও ১২টি থানা নিয়ে শুরু হয়েছিলো বর্তমানে সেখানে ৩৪০০০ জনবল কাজ করছে। উত্তীর্ণ হয়েছে ৫০টি থানায়।
মন-মননে অত্যন্ত উদার, মেধাবী এই মানুষটি টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর থানার ঘাটান্দি গ্রামে সম্ভ্রান্ত এবং শিক্ষানুরাগী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৪ সালের ১ অক্টোবর। বাবা মৃত খন্দকার হায়দার আলী এবং মা ফাতেমা বেগম। স্ত্রী শারমীন আক্তার খানের সাথে ঘাটছড়া বাঁধেন ১৯৯৩ সালে।
ব্যক্তি জীবনে তিন কন্যা সন্তানের বাবা তিনি। বড় মেয়ে ফাবলিহা খন্দকার’র জন্ম ১৯৯৬ সালের মে মসে। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। মেজো মেয়ে নাবলিহা খন্দকার’র জন্ম ২০০০ সালের ৯ অক্টোবর মাসে। কম্পিউটার সাইন্সে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করেন তিনি। ছোট মেয়ে তাসনিয়াহ খন্দকার জন্ম গ্রহণ করেন ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর মাসে। বর্তমানে কলেজে অধ্যয়ররত।
© স্বত্ব সংরক্ষিত © দৈনিক স্বাধীন বাংলাদেশ