সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এমডব্লিউ স্কুলের দুর্নীতির দায়ে বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমুল হুদাকে পুনঃরায় বহালের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকরা। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে অত্র স্কুলের সামনে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধন করে। মানববন্ধনে অত্র স্কুলের শিক্ষার্থী, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যবৃন্দ ও এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমুল হুদাকে যেনো পুনরায় স্কুলে বহান করা না হয় সেজন্য জোর দাবী জানানো হয়। যদি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষককে পুনরায় বহাল করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে আগামীতে বড় আন্দোলনের হুশিয়ারী উচ্চারন করেন মানববন্ধনকারীরা। স্কুলের সুনাম রক্ষায় দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তারা সকলের সহযোগীতা কামনা করেন।
মানববন্ধনে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা বলেন, গাজী নাজমুল হক একজন দুর্নীতিবাজ। তিনি প্রধান শিক্ষক হয়ে স্কুলে ঠিক মতো আসেন না। তিনি স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যর্থ। তার মতো শিক্ষক স্কুলে থাকলে স্কুলের সুনাম নষ্ট হবে। শিক্ষার মান নষ্ট হবে। একজন দুর্নীতিবাজ থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে। ৭ লাখ ৭৭ হাজার ১৯৪ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী তৎকালিন স্কুল পরিচালনা কমিটি প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমুল হুদাকে বরখাস্ত করেন। যা মাউশির আইন শাখার অফিসার ইনচার্জ মো. সিদ্দিকুর রহমান তদন্ত করে ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিক্ষকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন। আমরা এমন দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষককে পুনঃরায় স্কুলে দেখতে চাই না। আদমজী এমডব্লিউ স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রওশন আরা আক্তার বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমুল হুদাকে পুনঃরায় যোগদান করতে চাচ্ছেন, এমন খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকরা মানববন্ধন করে।
খোজ নিয়ে জানা যায়, বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমুল হক গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এমডব্লিউ স্কুলে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি অত্র স্কুলের শিক্ষার মান উন্নয়নে ব্যর্থ ছিলেন। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি সৃস্টি করেন। শিক্ষকসুলভ আচরনে ব্যর্থ ছিলেন, করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের এ্যাসাইনমেন্ট জমা ও প্রদানে ব্যর্থ, নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম, বই সংগ্রহ ও বিতরনে ব্যর্থ, মুজিববর্ষ পালনে বাধা, প্রধান শিক্ষক নিজের লাভের জন্য একদল শিক্ষকের সাথে অন্য শিক্ষকদের মধ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দ্বন্ধ লাগিয়ে উত্তেজনার পরিবেশ সৃষ্টি করেন। চাকরীতে যোগদানের পর থেকে ৫ মাস ২১ দিনের মধ্যে ৯১ দিন তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি বিদ্যালয়ের ল্যাবটব ও মোবাইল সিম নিজের কাজে ব্যবহার করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সাল থেকে ৩০জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সাধারন তহবিলে ছাত্র বেতনসহ অন্যান্য খাতে আদায়কৃত ৭ লাখ ৭৭ হাজার ১৯৪ টাকা বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসেবে জমা না দিয়ে নিজের কাছে রাখেন। যা এক বছর পর বিদ্যালয়ের কমিটির চাপে পরে বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসেবে জমা দিয়েছেন যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গত ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ সালে এই সকল কি কারনে করেছেন তা জানতে স্বশরিরে জবাব চায় তদন্ত কমিটি। কিন্তু প্রধান শিক্ষক এর কোন জবাব দাখিল করেন নাই। তাছাড়া প্রাক্তন সভাপতি জবাব চাইলেও তিনি জবাব দাখিল করেন নাই। এগুলো সকল তার দৃষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায় বিধায় ফেব্রুয়ারী ২০২১ সালে প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত হলেও তিনি বিধি মোতাবেক ভাতা পেয়ে যান বলে জানা যায়।
এদিকে আরো জানা যায়, এমডব্লিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুল হুদাকে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন অনিয়ম ও অর্থ আত্নসাতের অভিযোগে মন্ত্রণালয় তদন্ত রিপোর্ট প্রেক্ষিতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তাকে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের উপস্থিতিতে কারণ দর্শানোর জন্য বলা হলে তিনি আর উপস্থিত হননি। মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বাংলাদেশ মাউশির আইন শাখার অফিসার ইনচার্জ মো. সিদ্দিকুর রহমান তদন্ত করে ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিক্ষকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন। শিক্ষা বোর্ড সভাপতি এডহক কমিটিকে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অনুসরণপূর্বক বোর্ডকে অবহিত করতে বলেন। যদিও হাইকোর্টের আদেশটি প্রধান শিক্ষক নাজমুল হুদার নামে না, তথাপিও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয় সভাপতি যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে মর্মে অবহিত করেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর শিক্ষাবোর্ড প্রধান শিক্ষক বরখাস্তকরণ সম্পর্কিত বিষয়ে বোর্ডের আপিল এন্ড আরবিট্রেশন কমিটিতে আবেদনের নির্দেশনা প্রদান করেন। এর প্রেক্ষিতে বর্তমান কমিটি প্রধান শিক্ষকের চূড়ান্ত বরখাস্তের জন্য বোর্ডের আপিল এন্ড আরবিট্রেশন কমিটিতে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র প্রেরণ করেন। এদিকে তার বিরুদ্ধে হওয়া তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, তদন্তকালে সহযোগিতা প্রদানের জন্য তদন্তের একদিন পূর্বে অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন। এছাড়া মাউশি অধিদপ্তরের মাধ্যমিক উইং থেকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি আদেশ মোতাবেক তদন্তকার্য পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হলে এবং অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমূল হুদাকে তদন্তের বিষয়ে জানানো হলে তিনি তাঁর অসুস্থতার কথা বলে ১৫ দিনের সময় প্রার্থনা করেন। মাউশির আইন শাখার অফিসার ইনচার্জ মো. সিদ্দিকুর রহমান সব বিষয় বিবেচনা করে তাঁকে মৌখিকভাবে ৭ দিনের সময় মঞ্জুর করে ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি তদন্তের দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন। নিরীক্ষা রিপোর্টসূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর অ্যাডহক কমিটির সভাপতির নেতৃত্বে পূর্বে গঠিত নিরীক্ষা কমিটি ১৮ নভেম্বরের নিরীক্ষা রিপোর্ট আলোচ্যসূচি-১ এ উপস্থাপন করেন। নিরীক্ষা রিপোর্টে প্রধান শিক্ষকের ৭ লাখ ৭৭ হাজার ১৯৪ টাকা আত্মসাতের বিষয়ে প্রধান শিক্ষককে অবহিত করলে প্রথমে প্রধান শিক্ষক তা অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করলে অর্থ আত্মসাতের কথা প্রধান শিক্ষক তা স্বীকার করেন। সরকারি বিধি মোতাবেক, প্রধান শিক্ষক সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকার বেশি অর্থ হাতে রাখতে পারবেন না। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কেন বিধি বহির্ভূতভাবে ৭ লাখ ৭৭ হাজার ১৯৪ টাকা নিজের নিকট প্রায় এক বছর রাখলেন তার কারণ দর্শানোর জন্য নোটিশ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখের ১নং আলোচ্য সূচিতে প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের পদ হতে সাময়িক বরখাস্ত করণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং শিক্ষানবিশকালে সন্তোষজনক চাকুরীর বিধান পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়াও তিনি শিক্ষকদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেছেন বিধায় তিনি চাকুরী থেকে বরখাস্তের মতো অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন। তিনি ২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন অর্থবছরে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য খাতে আদায়কৃত ৭ লাখ ৭৭ হাজার ১৯৪ টাকা বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে যথা সময়ে জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং বিধি বহির্ভূতভাবে আদায়কৃত অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে নিজের নিকট রেখে দিয়েছেন, যা চাকুরী থেকে বরখাস্ত হওয়ার মতো অপরাধ করেছেন। এছাড়া তিনি ২০১০ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুমোদিতভাবে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত থেকেছেন, যা চাকুরী থেকে বরখান্ত হওয়ার মতো অপরাধ করেছেন। এছাড়াও তিনি করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া ও জমা নেওয়া ও নতুন বছরের শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম, বই বিতরণ, মুজিববর্ষ উদ্যাপনে অবহেলা করে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছেন। মাউশির আইন শাখার অফিসার ইনচার্জ মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, এমডব্লিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমানিত। তিনি ব্যক্তিগত লাভ ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিদ্যালয়ের কর্ম-পরিবেশের বিঘ্ন ঘটানোর কারণে শিক্ষক-কর্মচারীগণ সর্বসম্মতিক্রমে অনাস্থা প্রকাশসহ উল্লিখিত কারণসমূহের জন্য প্রধান শিক্ষক গাজী নাজমুল হুদার সাময়িক বরখাস্ত বিধি সম্মত বলে প্রতীয়মান হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
© স্বত্ব সংরক্ষিত © দৈনিক স্বাধীন বাংলাদেশ